আমান্ডা লিটল ভ্যানডরবিল্ট বিশ^বিদ্যায়ের একজন অধ্যাপক। তিনি সাংবাদিকতা এবং বিজ্ঞান-রচনা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। ‘খাদ্যের নিয়তি’ (The Fate of Food) শিরোনামে তিনি একটি বই লেখেন। তাঁর এই বই আমাদের কৃষি-গবেষণার প্রান্তিক সীমানার কিছু আশ্চর্যজনক বিষয় সম্পর্কে জানতে অদ্ভুত এক ভ্রমণে নিয়ে চলে। বইটি পড়তে পড়তে আমরা খাদ্য-বিজ্ঞানের কয়েকজন আশ্চর্যজনক দক্ষ (এবং ব্যস্ত) উদ্ভাবকের কথা জানতে পারি।
টনি জাংয়ের সাথে দেখা করাতে তিনি আমাদের সাংহাই নিয়ে গেলেন। টনি জাং চিনের একজন উদ্যোক্তা, যিনি চিনে মুদিদ্রব্যের চেইন স্টোর (দোকান) খোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কীটনাশক ব্যবহার করে চাষ করা দূষিত সবজি বিক্রির সময় জাং একদিন জানতে পারেন যে, সবজি-চাষিরা কেবল নিজেদের পরিবারের সদস্যদের খাওয়ার জন্য আলাদা জমিতে বিশেষ জৈব-পদ্ধতিতে সবজি চাষ করেন।
জাং তখন প্রচ- ক্ষেপে গিয়েছিলেন এবং তাঁর নিজের চার হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করতে শুরু করেন, যেখানে তিনি ইলেট্রিকাল সয়েল সেন্সর ব্যবহার করে জমির আর্দ্রতা, তাপমাত্র, অ্যাসিডিটি এবং আলো শোষণের তথ্য সংগ্রহ করেন। জমির তথ্য সংগ্রহের কাজ এবং প্রচুর দূষিত মাটি পরিষ্কার করা বাবদ জাংয়ের এত খরচ হয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত জাং কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে অন্য কোম্পানিগুলো ডিজিটাল সেন্সর কাজে লাগিয়ে তার ধারণা-কে (আইডিয়া) আরো উন্নত করেছিল।
সিলিকন ভ্যালিতে, ভারতীয় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ উমা ভালেটি ল্যাবরেটরিতে মাংস পরীক্ষা (কালচার) করার একটি কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটি আসল মাংস। কেবল একটি পেট্রি ডিশে [ল্যাবরেটরিতে ব্যাকটেরিয়া উৎপন্নের থালাবিশেষ] তৈরি হয়েছে ; কোনো প্রাণীর দেহে নয়। আমান্ডা লিটল দেখতে পান যে, হাঁসের মাংস সুস্বাদু, যদিও এর একটি মাত্র পরিবেশনের মূল্য এক লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি। এটি এখনো বাণিজ্যিক নয়। তবে এর মূল্য হ্রাস পাচ্ছে।
নরওয়েতে, আলফ-হেল্জ আরস্কোগ নামের একজন রুই মাছ (salmon) চাষি সমুদ্রের খাঁড়িতে সাগরের পানিতে খাঁচায় মাছ চাষ করেন। মাছচাষিরা তাদের সমস্যা দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বন্দি রুই মাছগুলোকে একসময় হিং¯্র সামুদ্রিক প্রাণী খাওয়ানো হতো। তবে পরিশীলিত খাবার পরিবেশনের লক্ষ্যে সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী হওয়ার জন্য বর্তমানে ৭৫% শস্য খাওয়ানো হয়।
‘সি লাইস’ [Ôsea liceÕ] হলো শক্ত আবরণযুক্ত একধরনের সামুদ্রিক উকুন। অল্প জায়গায় অনেক রুই মাছ একত্রে আবদ্ধ থাকলে সেই জায়গা এইসব সামুদ্রিক উকুনের প্রজনন ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই উকুেনর কবল থেকে মাছগুলো রক্ষা করতে আরস্কোগ এমন একটি রোবট ব্যবহার করেন, যেটি পানির ভেতর দিয়ে সামুদ্রিক উকুনগুলো ছুঁতে পারে এবং লেজারের সাহায্যে সেগুলো মেরে ফেলতে পারে।
রোবটগুলো হলো শুকনো জমি চাষের জন্য নতুন শ্রমিক। পেরুর প্রকৌশলী জর্জ হেরাউড এবং তাঁর ক্যালিফোর্নিয়ার সহকর্মীরা একটি ‘লেটুস বোট’ (Ôlettuce botÕ) উদ্ভাবন করেছেন যা চারা রোপণ ঘন হলে অতিরিক্ত চারাগুলো চিহ্নিত করে ক্ষেত পাতলা করে দিতে পারে, এবং অতি মাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে অতিরিক্ত গাছপালা মেরে ফেলতে পারে। জন ডিয়ার এই ধারণাটিতে এত সম্ভাবনা দেখছেন যে, করপোরেশন হেরাউড-এর সংস্থাটি ৩০ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলারে কিনে নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রীষ্মকালে বেশিরভাগ লেটুস ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্মে এবং শীতকালে জন্মে অ্যারিজোনার ইয়ুমা’র কাছাকাছি একটি মহাদেশে, যা পূর্ব-উপকূলীয় গ্রাহকদের বাজার থেকে দূরে। সাবেক কর্নেল অধ্যাপক ইডি হারউড এবং তার সহকর্মীরা এই সমস্যার সমাধান করেছেন। তারা নিউয়র্ক, নিউ জার্সি-তে পুরাতন ভবনে এলইডি বাতির নিচে মাটি ছাড়া বায়বীয় লেটুস জন্মাচ্ছেন।
এই লেটুসগুলো ৩০ থেকে ৪৫ দিনের বদলে ১২ থেকে ১৫ দিনে বাজারে বিক্রি করার মতো উপযোগী হয়ে ওঠে এবং খোলা মাঠের চেয়ে চারগুণ বেশি ফলন দেয়। এই পদ্ধতিতে লেটুস গাদা করে রাখা উঁচু ট্রেতে জন্মে, তাই প্রচলিত খামারের চেয়ে এই ক্ষেত্রে হেক্টর প্রতি ফলন ৩৯০ গুণ বেশি হতে পারে।
বইটি [The Fate of Food] আকস্মিক বোধ বা পরিজ্ঞানে [insights] পরিপূর্ণ। যেমন ১৯৩০ সালের দিকে ইসরায়েলের প্রকৌশলী সিমচা ব্লাস ড্রিপ ইরিগেশন বা ‘ফোঁটা ফোঁটা সেচ’ ব্যবস্থাটি উদ্ভাবন করেন। তিনি মরুভূমিতে একটি গাছকে বেড়ে উঠতে এবং সতেজ হতে দেখেছিলেন। এর জন্য তিনি কাছাকাছি জায়গায় অযত্নে পড়ে থাকা একটি ফুটো পানির নলকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
লিটল অবশ্য অল্প কিছু সাম্প্রতিক উদ্ভাবন সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপন্ন ৯০% ভুট্টা, সয়া এবং তুলা জিনগতভাবে পরিবর্তিত। বেশিরভাগই উচ্চমাত্রায় ভেষজনাশক ব্যবহার করে জন্মানো হয়। এখন অবশ্য পিগওয়েড [এক ধরনের আগাছা, যা শূকরের চারণ হিসেবে ব্যবহার হতে পারে] ভেষজনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০ কোটি একর (২৮ কোটি হেক্টর) জমি এই আগাছায় ভরে গেছে।
অধ্যাপক ক্যালেস্টাস জুমা-এর কাছ থেকে জেনেছি যে, নতুন উদ্ভাবনগুলো প্রায়শই প্রথম দিকে বেমানান দেখায় ; খামারের কাজে ব্যবহার করার জন্য প্রথম যখন ট্রাক্টর চালু হয়েছিল সে-সময়ে খামারের কাজে ব্যবহৃত ঘোড়াগুলোর সাথে ট্রাক্টরের সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতা করার মতো অবস্থায় যেতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল ।
যে-সব উদ্ভাবনের কথা লিটল তার বইতে তুলে ধরেছেন তার কোনগুলো যে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন করবে, সেটা বলা খুবই মুশকিল। তবে বড়ো তথ্য-উপাত্ত, রোবট এবং অভ্যন্তরীণ চাষ সবই এর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। উত্তর ভার্জেনিয়ার তরুণ দম্পতি ক্রিস এবং অ্যানি নিউম্যানের শূকর, মুরগি ; ফল ও বাদাম চাষের পারম্যাকালচার-এর সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরে লিটল তার বই শুরু এবং শেষ করেন।
নিউম্যান দম্পতি পরিবেশবাদী এবং প্রযুক্তিপন্থী ; তারা সেই দিনের স্বপ্ন দেখছেন যেদিন তারা তাদের খামারে রোবট ব্যবহার করে আগাছা পরিষ্কার করতে পারবে। সবশেষে এই কথা বলা যায় যে, ভবিষ্যতে ডিজিটাল পদ্ধতি আরও তরুণদের উচ্চফলনশীল জৈব-পরিবার কৃষিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করে তুলবে।
আরও পড়ুন
Little, Amanda 2019 The Fate of Food: What We’ll Eat in a Bigger, Hotter, Smarter World. New York: Harmony Books. 340 pp.
ভিডিও দেখুন
হাইড্রোপোনিক ঘাস
https://www.accessagriculture.org/bgl/haaiddroponik-ghaas
Forecasting the weather with an app
https://www.accessagriculture.org/forecasting-weather-app