কৃষকেরা উদ্ভাবনের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে, যতক্ষণ না তাঁরা সেইসব কৃষকদের সাথে দেখা করে আলোচনা করেন, যাঁরা ইতোমধ্যে ওই নির্দিষ্ট ধারণাটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিলেন। ২০১৫ সালে কেনিয়ার পশ্চিম পোকেটের কোরেলাচ গ্রামের কৃষকেরা এমনই একটি সমস্যায় ভুগছিলেন। জমি এতটাই ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল এবং চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল যে, সেখানে ফসল উৎপাদন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেখানকার বহু অধিবাসী সমাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর তারা নিকটস্থ এলডোরেট বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ওই গবেষক দল জমির ক্ষয়জনিত সমস্যা নিয়ে ভুগছে এমন একটি জনগোষ্ঠী খুঁজছিলেন। গবেষক দল দ্রুতই সনাক্ত করতে পেরেছিলেন যে, বালি উত্তোলনের কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। শহর থেকে দালালেরা এসে শুষ্ক নদীর তলদেশ থেকে লরি বোঝাই করে বালি নিয়ে যেত। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটি দল বেলচা দিয়ে এক-ট্রাক বালি ভরতি করে দিয়ে তিন হাজার শিলিং বা ত্রিশ মার্কিন ডলার উপার্জন করত, কিন্তু অন্য কোনো গ্রামাবাসী এর থেকে উপকার পেত না। নির্মাণকাজে ব্যবহার করার জন্য নিকটস্থ শহরে এক-ট্রাক বালি তারা ছয় হাজার শিলিং বা ছয়শো মার্কিন ডালারে বিক্রি করত।
প্রচুর বালি উত্তোলন করার ফলে শুকনো নদীর তলদেশে এত গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছিল যে, লোকেরা এর ওপর দিয়ে হাঁটতে পর্যন্ত পারত না। প্রতিবেশীদের সাথে দেখা করতে কিংবা খামার তদারক করতে নদী পার হওয়া তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। গবেষকবৃন্দ যখন গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে বললেন, দালালেরা বালি বিক্রি করে কত টাকা আয় করছে, তখন গ্রামবাসীরা বললেন, “আমরা এই গলি আটকাতে দিতে পারি না, আমাদের এটি ধরে রাখতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।”
গ্রামবাসীরা একত্র হয়ে বালি উত্তোলন বন্ধ করে দেয়। পরের বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশের গর্তগুলো বালি দিয়ে ভরাট হতে থাকে। এতে তাঁদের গলিটি পার হওয়া সহজ হয়ে ওঠে এবং নদীর পার স্থির হয়ে যায়। কোরেলাচের একটি গির্জার একজন মন্ত্রী স্থানীয় সরকারকে নদীর তীরে একটি কূপ (বোরহোল) খনন করার জন্য রাজি করান, যাতে গ্রামের নারীদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য জল আনতে অনেক দূরে যেতে না হয় এবং তাঁরা বাড়ির কাছাকাছি উৎস থেকে ব্যবহারের জল সংগ্রহ করতে পারেন।
এই সাফল্য গবেষক দলের নতুন মাটি ও জল সংরক্ষণ কৌশল প্রস্তাব করার জন্য গ্রামবাসীদের মাঝে যথেষ্ট আস্থা তৈরি করেছিল। বিশ^বিদ্যালয়টি ২০১৬ সালের মে মাসে নতুন কৌশল সম্পর্কে জানার জন্য কোরেলাচ থেকে পাঁচ জন কৃষককে ইথিয়োপিয়ার টাইগ্রেতে নিয়ে যায়। যাহোক, ফল ছিল হতাশাজনক। কেননা, কেনিয়ার কৃষকদের তাঁদের সহকর্মীদের সাথে দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলতে হয়েছিল। তবে, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ ছিল তাতে এই প্রকল্পটি কেবল কেনিয়ার কয়েক জন মাত্র কৃষককেই নিতে পেরেছিল।
ওই পাঁচ জন কৃষক ফিরে এসে গ্রামের অন্যদের নতুন কৌশল ব্যবহারে রাজি করাতে পারেননি। অন্য গ্রামগুলো থেকে কেউ ইথিয়োপিয়ায় যায়নি, এবং তাঁরা এখনও সন্দিহান যে, সহজ কৌশলগুলোর মাধ্যমে আদৌ জমি উন্নত করা যায় কি না।
তারপর ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে গবেষক দল ভিন্ন একটি কৌশল খাটাতে চেষ্টা করেছিল। তারা কোরেলাচ থেকে বাস ভরতি করে কৃষকদের কেনিয়ার ওপাশে মাচাকোসে নিয়ে যান। এতে বেশ কিছু সুবিধা হয়েছিল। এলডোরেট বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলসন এনগেটিচ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন : প্রথমত, বাসে অনেক লোক যেতে পারে, ফলে গ্রামের নারী ও তরুণেরা স্বাচ্ছন্দ্যে যেতে পেরেছিলেন, আগের বার কেবল জ্যেষ্ঠ পুরুষেরা ইথিয়োপিয়ায় গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ কেনিয়ান তাদের স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি কিসোওয়ালি ভাষায় কথা বলে, ফলে কোরেলাচের কৃষকেরা নির্দ্বিধায় মাচাকোসের কৃষকদের সাথে কথা বলতে পেরেছিলেন।
এ যাত্রায় কোরেলাচের কৃষকেরা যা দেখেছিলেন তাতেই তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, “মোচাকোসের সেই কৃষকদের জমি আমাদের চেয়ে খারাপ, কিন্তু তাঁরা আমাদের চেয়ে ভালো যতœ করে।”
পরিদর্শনের পরে, গবেষক দল কোরেলাচের অধিবাসীদের জল ও মাটি সংরক্ষণের বিষয়ে তাঁদের নিজস্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে সহযোগিতা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যেমন, হাতে তৈরি মাটির ‘বালির বাঁধ’ দেওয়া, যাতে বৃষ্টির জলের প্রবাহকে ধীর করে দেওয়া যায়, এতে জলের তোড়ে মাটি ধুয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মাটি ভিজে থাকবে। কৃষকেরা ‘কভার ফসল’ (যে-ফসলের চাষ মাটি ঢেকে রাখে এবং মাটি উন্নত করতে সহায়তা করে) চাষের চেষ্টা করেছিলেন, যেমন শিম-জাতীয় ফসল, যা মাটির নাইট্রোজেন ঠিক রেখে এবং বায়োমাস ধরে রেখে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
কোরেলাচবাসী এখন অন্যান্য ধারণাগুলো চেষ্টা করার জন্য প্রস্তুত, যেমন তারা এখন ফলের গাছ এবং বহুমুখী শিমের চাষ করছে (যা কেবল মাটি উন্নতই করে না লোকের খাদ্যেরও ব্যবস্থা করে)।
এলডোরেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সিফিলিন কেবিন ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমরা অন্য জায়গা থেকে সমাধান বহন করে আনতে চাইনি। আমরা এই ধারণা শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম যে, গ্রামবাসীরা নিজেদের সমস্যা যেন তাঁরা নিজেরাই সমাধান করতে পারেন।”
কৃষকেরা ভবিষ্যতের জন্য আরও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ইতিবাচক ধারণা পেতে শুরু করেছেন। একজন কৃষক তাঁর ফলের গাছগুলোকে এত প্রাণবন্ত দেখে কল্পনা করতে পারেন যে, তিনি বলেন, “আমি আম ভরতি একটি বস্তা আমার পিঠে নিয়ে বাজারে যাচ্ছি।”
এই অভিজ্ঞতা থেকে এটা বোঝা যায় যে, ক্রস-সাইট পরিদর্শন (একে অপরের খামার বা কাজ পরির্দশন) কৃষকদের উদ্দীপ্ত করতে পরে, নিজেদের মনোবল ফিরেয়ে আনতে, সহযোগিতামূলক গবেষণায় নিয়োজিত করতে এবং তাঁদের নিজেদের চাষের জমির জন্য একটি ভিন্ন ভবিষ্যৎ দেখতে আগ্রহী করে তুলতে পারে।
স্বীকৃতি
কোরেলাচের কাজটি স্পন্সর করেছিল ম্যাকনাইট ফাউন্ডেশনের কোলেবরেটিভ ক্রোপ রিসার্স প্রোগ্রাম (সিসিআরপি)।
Related Access Agriculture videos
Grass strips against soil erosion