আমরা সবাই জৈব-দুধ, জৈব-ফল ও সবজি বা জৈব-চকলেটের কথা জানি। তবে, যখন কেউ ‘অর্গানিক শ্রীলঙ্কা’ পড়বেন, তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে যে, এটি মূলত কী নিয়ে লেখা ? নিশ্চিতভাবেই এটা পুরো দেশকে জৈব বোঝায় না, আবার বোঝাতেও পারে ?
প্রকৃতপক্ষে, এপ্রিল ২০২১ অনুসারে, ধান চাষিদের মধ্যে ব্যাপক হারে কিডনি রোগ দেখা দেয়, ফলে শ্রীলঙ্কান সরকার সবরকমের রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং আগাছানাশক আমদানি নিষিদ্ধ করে দেওয়ার এবং কৃষিকাজকে জৈব ও পরিবেশবান্ধব কৃষিতে রূপান্তর করার সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়।
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। দেশটির তামিল ও সিংহলী জাতির মধ্যে দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জাতিগত বিভেদের কারণে ৩০ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ লেগে ছিল, যা মাত্র ২০০৯ সালে শেষ হয়। মনোরম দৃশ্যাবলি এবং প্রচুর আবাদযোগ্য ও উর্বর ভূমির আশীর্বাদে শ্রীলঙ্কা পর্যটন, টেক্সটাইল, চাল ও চা-য়ের ওপর ভিত্তি করে একটি উন্নত ও স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এসব পণ্য রপ্তানিতে শ্রীলঙ্কা বিশ্বে দ্বিতীয়।
যা হোক, কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার কৃষিনীতিগুলো উচ্চ-ইনপুট কৃষিভিত্তিক ছিল। সরকার বিনামূল্যে সেচ ও রাসায়নিক সারে ভর্তুকি দেয়। ফলে ধীরে ধীরে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষ, জমি ও জল- যেগুলোর ওপর কৃষি নির্ভরশীল, সেগুলোর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্তও নজরে আসেনি।
১৯৯৫ সালে, আমি যখন ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মম-লীয় কৃষি বিষয়ে পড়াচ্ছিলাম, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রকল্পে সহযোগিতা করার সুবাদে কয়েক মাস ওই সুন্দর দেশে বসবাস করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। প্রকল্পটি মূলত আগাছা ব্যবস্থাপনার ওপর কাজ করছিল এবং আমাকে পরিবেশগত কারণ এবং কৃষকদের চর্চার সাথে সম্পৃক্ত কৃষি-ক্ষেতের আগাছার সংখ্যা নিরূপণের জন্য গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে গাছপালা বাস্তুবিদ্যার সংখ্যাতত্ত্ব ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল।
সে-সময়ে আমি প্রতিসপ্তাহে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছি এবং সারাদিন গ্রামে থেকেছি ; কৃষকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং তাদের ক্ষেত পরিদর্শন করেছি। সেটি খুবই উদ্দীপনার সময় ছিল, তখন প্রায়ই আমি বাসস্থানে যেতে পারিনি এবং খুব অল্প কিছুক্ষণ ঘুমাতে পেরেছি। তবে, এই প্রক্রিয়াটি একইসময়ে ক্ষেতে থেকে ক্ষুদ্র-চাষিদের সাথে আমার কাজ করার ইচ্ছেকেও জাগিয়ে তুলেছে।
বেলজিয়ামে ফিরে এসে তথ্য বিশ্লেষণের পর আমি একটি বিস্ময়কর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছি, যা আমি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থাপিত আমার প্রথম গবেষণাপত্রগুলোর একটিতে লিখেছি। ‘ইচিনোক্লোয়া ক্রুস-গালি’ মহাওয়েলি উন্নয়ন কর্মসূচিতে ঘাসযুক্ত আগাছা লক্ষণীয়ভাবে দেখা গেছে, এটি দেশের বৃহত্তম সেচ-প্রকল্প, যেখানে উচ্চমাত্রার আগাছানাশক এবং সার ব্যবহার করে ধান চাষ করা হতো। সেখানে ব্যবহৃত আগাছানাশক ই. কোলোনামের মতো অন্যান্য জংলি ঘাসের বিস্তার প্রতিরোধ করতে পারছে না।
বহু বছর ধরে প্রোপানিল স্প্রে করার ফলে বিশে^র সবচেয়ে কষ্টদায়ক দুটি আগাছার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। প্রোপানিল একটি স্পর্শকাতর আগাছানাশক। প্রোপানিলের স্পর্শে আগাছা ধ্বংস হয়। এটি আগাছার সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে আগাছা মেরে ফেলে। এতে ফসলের খুব সামান্যই ক্ষতি হয়। প্রোপানিল বিভিন্ন ব্র্যান্ড-নামে বিক্রি হয় এবং গত ৬০ বছর ধরে সারাবিশ্বে ব্যাপকহারে এর ব্যবহার হচ্ছে।
শুরুর দিনগুলোতে মনসান্টো প্রোপানিলের পেটেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করে, তখন থেকেই ‘বায়ার’ উৎপাদিত আগাছানাশকটি বিশ^জুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, (যেটি মনসান্টে ২০১৬ সালে কিনে নেয়)। এছাড়াও আরও অনেক কোম্পানি প্রোপালিন উৎপাদন ও বিক্রি করে। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘ডো এগ্রো-সায়েন্স’, চিনা অনেক কৃষি-রাসায়নিক কোম্পানি, ভারতের ‘ভারত গ্রুপ’ ও ইউনাইটেড ফসফরাস অন্যতম। কৃষি-রাসায়নিকের মাধ্যমে তৈরি হওয়া পরিবেশগত এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকগুলো প্রকাশ পেতে সময় লাগে, সেইসাথে কৃষকদের ক্ষেতে প্রয়োগ করা রাসায়নিকের ককটেলগুলোর বিষের প্রভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
তার ওপর, একবার প্রয়োগ কারার পরে কীটনাশকগুলো (আগাছানাশক-সহ) ছোটো ছোটো ভাগে (ইউনিটে) বিভক্ত হয়ে যায়, যাকে ‘মোটাবোলাইট’ বলে। বিজ্ঞনীরা এগুলো শনাক্ত করতে পারেন না, ফলে এগুলো নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরক্ষিাও করা যায় না। তবুও, মোটাবোলাইটগুলো প্রায়শই তাদের পূর্ব-পুরুষের চেয়ে বেশি স্থায়ী ও বিষাক্ত হয়ে থাকে। এইসব জটিলতার আংশিক ব্যাখ্যা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বিধ্বংসী ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘পেস্টিসাইড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’ নামের একটি এনজিও-র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায় বৃষ্টিতে অন্যান্য কীটনাশকের সাথে প্রোপানিলের মাত্রা বিভিন্ন পরিমাণে পরিমাপ করা যায়। “কীটনাশক বাতাসের মাধ্যমে হাজার হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে ; নদী ও সমুদ্রের পানিতে মিশে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতে পারে ; তারা উপকারী পোকামাকড়-সহ জীববৈচিত্র্যের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলছে ; তারা খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নষ্ট করছে ; তাদের কারণে প্রতিবছর অজানা সংখ্যক কৃষক, শ্রমিক, কর্মী, শিশু ও পশু মারা যাচ্ছে। তারা তাদের জিন পুল পরিবর্তন করে ফেলে এবং তাদের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে সমাজের লক্ষ কোটি ডলার খরচ হয়ে যাচ্ছে (পেস্টিসাইড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক)।”
রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকগুলোতে ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কোবাল্ট, সিসা এবং নিকেলের মতো ভারি ধাতু থাকে। এগুলো মারাত্মক বিষাক্ত এবং অন্তঃপ্রবাহ বিনষ্টকারী হিসেবে পরিচিত। এই ভারি ধাতুগুলো কীটনাশকের পাত্রের লেবেলে তালিকাভুক্ত থাকে না। কেননা, এগুলোকে ছোটোখাটো দূষক হিসেবে বিবেচনার করা হয়। যাই হোক, কৃষি-রাসায়নিকের বারবার ব্যবহারের ফলে ভারি ধাতুগুলো মাটিতে জমতে থাকে।
শ্রীলঙ্কার সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকেরা বছরের পর বছর ধরে কৃষি রাসায়নিকের মারাত্মক বিধ্বংসী প্রভাবের ইঙ্গিত দিয়েছেন। ‘কলম্বো টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে ৩২০ জনেরও বেশি প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত ‘শ্রীলঙ্কান কৃষক ফোরাম’ সতর্ক করেছিল যে, কৃষি গবেষণার বর্তমান প্রবনতা- “উচ্চ ইনপুট ফসলের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা আমাদের ফসলের স্বাধীনতা হরণ করছে।”
মাটি ও পানির ক্ষতির কারণে মানুষের স্বাস্থ্য-ঝুঁকির যথেষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত সত্যিকার অর্থেই কেউ কথা শোনেনি।
জৈব ও পরিবেশগত চাষের জ্ঞান অত্যন্ত নিবিড়। শ্রীলঙ্কার কৃষকদের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান কয়েক দশকের রাসায়নিক কৃষির কারণে কীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে তা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়।
তবুও কৃষি-রাসায়নিক শিল্প সহজে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে না। রাষ্ট্রপতি শ্রীলঙ্কা-কে শতভাগ জৈব ঘোষণা করার ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে কৃষি-রাসায়নিক শিল্পের লবি গ্রুপগুলো গণমাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে জনমনে এই ধারণা তৈরি করছে যে, শ্রীলঙ্কার খাদ্য-সংকট দেশটির জৈব-চাষে ফিরে যাওয়ারই ফল। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, ক্রমবর্ধমান খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার নামে যে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি এখনও পর্যন্ত দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন।
বিষাক্ত ও প্রবল সক্রিয়তা ছাড়া জমির ব্যবস্থাপনা এবং মাটির উর্বরতা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে শ্রীলঙ্কার কৃষকেরা অন্যান্য দেশের তাদের সহকর্মী কৃষকদের কাছ থেকে শিখতে পারে। একই সময়ে কৃষি-সম্প্রসারণ এবং কৃষি-শিক্ষা ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।
আর সে-কারণে আমাদের অলাভজনক সংস্থা অ্যাকসেস এগ্রিকালচার ‘লঙ্কান অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্ট’ (এলওএএম)-এর সাথে অংশীদারী ভিত্তিতে এবং সংস্থার অনেক কৃষক থেকে কৃষক প্রশিক্ষণ ভিডিও স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করে শ্রীলঙ্কান সরকারকে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ধরনের শেখার সরঞ্জামগুলো কৃষক, সম্প্রসারণকর্মী এবং বিজ্ঞানীদের, যারা কৃষকদের সাথে আরও সহযোহিতামূলক উপায়ে গবেষণা করতে চান, তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অসামান্য সহায়ক হবে।
অধিক তথ্য
Devinder Sharma. 2021. Sri Lanka goes organic. The Tribune.
https://www.tribuneindia.com/news/comment/sri-lanka-goes-organic-318938
Ranil Senanayake. 2015. Restoring sustainability to Sri Lankan agriculture. Colombo Telegraph.
https://www.colombotelegraph.com/index.php/restoring-sustainability-to-sri-lankan-agriculture/
Vineet Kumar. 2021. Sri Lanka’s inorganic transition to organic farming. Down To Earth.
অনুপ্রেরণামূলক প্ল্যাটফর্ম
Access Agriculture (অ্যাকসেস এগ্রিকালচার): প্ল্যাটফর্ম টেকসই মাটি ও পানি ব্যবস্থাপনা, শস্য ও পশুসম্পদ এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রভৃতি বিষয়ে ২২০টি ভাষায় ৯০টিরও বেশি প্রশিক্ষণ ভিডিও ধারণ করে।
EcoAgtube (ইকোএগটিউব): একটি সামাজিক মাধ্যম ভিডিও প্ল্যাটফর্ম, যেখানে পৃথিবীর যে-কেউ তাদের প্রাকৃতিক চাষাবাদ এবং পুনরাবৃত্ত অর্থনীতি (সারকুলার ইকনোমি) সম্পর্কিত ভিডিও আপলোড করতে পারেন।