আজ তিনি তাঁর সফল জৈব-পণ্যের ব্যবসা ‘সিলভিয়াস বাস্কেট’-এর জন্য কেনিয়া এবং এর বাইরে সুপরিচিত। এই ব্যবসাটি তিনি শুরু করেছিলেন ২০১৬ সালে সেন্ট্রাল কেনিয়ার লিমুরু-তে। কিন্তু মনের মধ্যে, সিলভিয়া কুরিয়া সেই একই তরুণী মা যিনি 12 বছর আগে তার কিচেন গার্ডেনে জৈব সবজি চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে তার সন্তানরা নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর খাবার পেতে পারে। কিচেন গার্ডেন হলো বাড়ির আঙিনায় করা সবজি ও ফলের বাগান, যাতে রান্নাঘরের বর্জ্র্য পানি ব্যবহার করা হয়।
সিলভিয়া বলেন, “আমি এখন আমার এই জ্ঞান শেয়ার করার একটি মিশনে আছি, যাতে আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিজন মা তার সন্তানদের রাসায়নিকমুক্ত খাবার খাওয়াতে পারে, এমন খাবার যা পুষ্টিকর কিন্তু ক্ষতিকর নয়; এমন খাবার যা নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য।” মায়েদের কেন তাঁদের শিশুদের বিষাক্ত পদার্থ স্প্রে করা খাবার খাওয়ানো বন্ধ করা উচিত সে সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করে তুলতে সিলভিয়া একজন আগ্রহী অ্যাডভোকেটের মতোই কাজ করছেন।
আফ্রিকায় ফসলে কীটনাশকের ব্যবহার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, এতে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে এটি এখন একটি বড়ো উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর আফ্রিকায় পাঁচ কোটি শিশু রয়েছে, যারা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে; ফলে তাদের শারীরিক বৃদ্ধি হচ্ছে না। শৈশবের শুরু থেকেই প্রচুর শাক-সবজি-সহ বৈচিত্র্যময় খাদ্য খাওয়ালে শিশুরা স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
সিলভিয়ার কিচেন গার্ডেন বড়ো হতে থাকলে তিনি উদ্বৃত্ত ফসল শহরে তার বন্ধুদের কাছে বিক্রি করতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, “এভাবেই আমার কোম্পানি ‘সিলভিয়াস বাস্কেট’-এর জন্ম হয়েছিল।” তাঁর জৈব-খামারের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য তিনি লিমুরু-তে প্রায় ছয় হেক্টর জমির ব্যবস্থা করেন।
তার সব গ্রাহকের কাছে তাজা জৈব-খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে ২০১৯ সালে তিনি নাইরোবিতে একটি দোকান খোলেন। অল্প বয়সী মায়েরা তাঁর প্রধান গ্রাহক, যাদের কাছে তিনি তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছেছেন। এদের বেশিরভাগই নিজেদের পরিচিত অন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে জেনে সিলভিয়ার দোকানে আসেন।
সিলভিয়ার প্রতিবেশীরা আসা-যাওয়ার পথে তাঁর কিচেন গার্ডেনের ধারে থেমে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে, তিনি কীভাবে নানারকমের সবজি চাষ করতে সক্ষম হয়েছেন? তাই সিলভিয়া স্বেচ্ছায় তাদের, বিশেষ করে, তাঁর জনগোষ্ঠীর অল্পবয়সী মায়েদের কীভাবে বাগান তৈরি করতে হবে, চাষাবাদের নীতি মেনে কীভাবে শাক-সবজি উৎপাদন করতে হবে তা শেখান। সিলভিয়া বলেন, “কিচেন গার্ডেন তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে, তাদের খাদ্য সরবরাহ করে এবং এটি নগদ অর্থেরও একটি ভালো উৎস।”
সিলভিয়া তাঁর প্রশিক্ষণের জন্য দরকারি প্রশিক্ষণ উপযোগী সম্পদ-উপাদান খুঁজছিলেন। ২০১৯ সালে কেনিয়াতে কৃষিবিদ্যার ওপর অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে অ্যাকসেস এগ্রিকালচার-এর মানসম্পন্ন কৃষক প্রশিক্ষণ ভিডিওগুলোর সন্ধান পান। অ্যাকসেস এগ্রিকালচার (www.accessagriculture.org) বিশ্বের ৯০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় ভাষায় ২০০টিরও বেশি প্রশিক্ষণ ভিডিও হোস্ট করে, যেগুলো পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে বসে অবাধে ডাউনলোড করা যায়।
সিলভিয়া বলেন, “আমাদের স্থানীয় ‘কিকুয়ু’ ভাষায় বেশ কিছু অ্যাকসেস এগ্রিকালচার ভিডিও পাওয়া যায়, যার মানে আমাদের কৃষকেরা সবাই ভিডিওগুলো দেখে কৃষি-অনুশীলন ও কৃষিনীতিগুলো বুঝতে পারবে।” তিনি আরও বলেন, “আমি এই ভিডিওগুলোকে অত্যন্ত কার্যকর বলে মনে করি এবং ভিডিওগুলোতে যে উপায়ে সবকিছু দেখানো হয়েছে তা পছন্দ করি। কেননা, এতে লোকেরা ভিডিও দেখে যা কিছু শিখবে তা ভুলে যাবে না।”
সিলভিয়া যেখানে বসবাস করেন, সেই লিমুরু-র এনডিইয়া এলাকা আধা-শুষ্ক একটি অঞ্চল। তাই সেখানে অর্থকরী ফসল উৎপাদনের জন্য এগ্রোইকোলজিক্যাল অবস্থা খুবই কঠোর। স্থানীয় লোকেরা বছরের বেশিরভাগ সময় খাদ্য নিরাপত্তাহীতায় ভোগে। সিলভিয়া ব্যাখ্যা করে বলেন, “সুতরাং খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল আমাদের নারীদের সারাবছর ধরে তাদের নিজস্ব খাদ্য উৎপাদন করতে শেখানো আর এ-কারণেই টেকসই ভূমি-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কিছু ভিডিও খুবই উপযোগী।”
অ্যাকসেস এগ্রিকালচার এন্টারপ্রেনরস ফর রুরাল অ্যাকসেস (ERA)-এর প্রত্যেকটিতে একটি করে সৌর-চালিত স্মার্ট প্রজেক্টর দিয়ে সাজানো অ্যাকসেস এগ্রিকালচার ভিডিওগুলোর সম্পূর্ণ লাইব্রেরি রয়েছে। কেনিয়াতে অ্যাকসেস এগ্রিকালচার এন্টারপ্রেনরস ফর রুরাল অ্যাকসেস (ERA) চালু হওয়ার সাথে সাথে সিলভিয়া তার এলাকার কৃষকদের প্রাসঙ্গিক ভিডিওগুলো দেখানোর জন্য কাছাকাছি অবস্থান থেকে পরিষেবাগুলো ভাড়া করতে সক্ষম হয়েছেন।
সিলভিয়া জানান, “আমাদের প্রশিক্ষণের জন্য সোলার প্রজেক্টর কিটগুলো অত্যন্ত উপকারী। আমরা ভিডিওগুলো দেখতে এবং সেগুলো দেখে শিখতে দারুণ উপভোগ করি। কেননা, এগুলো এমন সব সমাধানগুলো দেখায় যেগুলো প্রয়োগ করা খুবই সহজ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের কৃষকেরা ভিডিওগুলো দেখে এতটাই উতলা যে, তাদের সেগুলো দেখা থেকে বিরত রাখা প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে। তারা কীটপতঙ্গ-ব্যবস্থাপনার ভিডিওগুলো সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে।”
সিলভিয়া কেনিয়াজুড়ে একহাজারেরও বেশি নারী ও ছোটো আকারের কৃষক গোষ্ঠীকে জৈব-চাষের মৌলিক ধারণাগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত করতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সহযোগিতা করছে। ২০১৯ সালে তাঁকে GIZ নলেজ সেন্টার ফর অর্গানিক এগ্রিকালচার ইন আফ্রিকা (KCOA) প্রকল্প থেকে জৈব-চাষাবাদের মাস্টার প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
সিলভিয়া বলেন, “জৈব-খাদ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, মানুষের মধ্যে সচেতনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা, ভূমিক্ষয় প্রভৃতি কারণে কৃষকেরা জৈবচাষ সম্পর্কে জানতে এবং তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছে। আমরা কৃষকদের তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারে প্রবেশ করাতে এবং ভোক্তাদের জন্য জৈব-পণ্যগুলো সাশ্রয়ী করতে সহায়তা করার লক্ষ্যে কাজ করছি।”
এটি করার জন্য, কৃষকদের তাদের উৎপাদিত পণ্যের একটি নির্ভরযোগ বাজার পাইয়ে দিতে সিলভিয়া এখন কেনিয়া অর্গানিক এগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক (KOAN) এবং পার্টিসিপেটরি ইকোলজিক্যাল ল্যান্ড ইউজ ম্যানেজমেন্ট (PELUM) অ্যাসোসিয়েশনের ক্ষুদ্র জৈব-কৃষকদের সাথে জৈব-খাদ্য উৎপাদন থেকে বিপণন ব্যবস্থা পর্যন্ত সমগ্র ভ্যালু চেইনে মনোনিবেশ করেছেন।
সিলভিয়া মন্তব্য করেন, “নিরাপদ খাদ্য একটি মৌলিক মানবাধিকার। আমি বিশ্বাস করি, কিচেন গার্ডেন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানের এবং এমনকি পৃথিবীকে একটি উপায়।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আফ্রিকা মহাদেশের জন্য আমার লক্ষ্য হলো, যতটা সম্ভব কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সহায়তা করা যাতে আমরা আমাদের সম্পদের সর্বোত্তম উপভোগ করতে পারি এবং আমাদের শিশুদের জন্য একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারি।”