মেডিটেরিনিয়ান ফলের মাছি একটি খুব ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ। এই পতঙ্গ মেডফ্লাই নামেও পরিচিত। এই মাছি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলজুড়ে কমলা আমসহ অন্যান্য ফলে আক্রমণ চালায় এবং খেয়ে ফেলে। প্রতিটি মহিলা মেডফ্লাই তার জীবদ্দশায় ২০০টি ডিম দিতে পারেন, এতে খুব দ্রুত এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মেডফ্লাই এত বেশি মূল্যের ফলের ক্ষতি করে যে, অনেকে এদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে চায়।
মেডফ্লাই অদ্ভুত ধরনের কিছু প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। যেমন, ১৯৮০ সালের দিকে লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলিতে মালাথিয়ন [কীটনাশক] স্প্রে করা হয়। তারপর পুরুষ মাছিদের প্রজননে অক্ষম করার কৌশলও ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে আমেরিকার সাইট্রাস ফল অঞ্চল পর্যন্ত এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়। যেখানে কয়েক কোটি মাছি ল্যাবরেটরিতে লালনপালন করা হয় এবং পুরুষ মাছিদের প্রজনন অক্ষম করার জন্য প্রচুর পরিমাণে অস্বচ্ছ বিকিরণ প্রয়োগ করা হয়।
এরপর এই অসহায় পুরুষ মাছিগুলোকে বিমান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বন্য স্ত্রীদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য, যেন তারা বংশ বৃদ্ধি করতে না পারে। গুয়েতেমালার সমস্ত অঞ্চলে ফলের মাছি নির্মূল করার এই কর্মসূচিগুলোকে উদাহরণ হিসেবে প্রায়শই সফল, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব বলে বর্ণনা করা হয়। যদিও এগুলো বড়ো, ব্যয়বহুল ও উচ্চপ্রযুক্তিগত কর্মসূচি।
হালকা প্রযুক্তি প্রয়োগ করেও চেষ্টা করা হয়। বলিভিয়ায় প্রায় ২০ বছর ধরে সোডা পপ বোতলের ফাঁদ ব্যবহার করা হয়, যদিও ব্যাপকভাবে এর প্রচলন হয়নি। আপনি একটি প্লাস্টিকের পানীয় বোতল জোগাড় করুন, বোতলের উপরের দিকে একপাশে মাছির আকারের কতগুলো ছোটো ছিদ্র করুন, বোতলের ভেতরে আধাকাপ কমলার রস ঢেলে দিন এবং বোতলটি বাগানে কাঁধ সমান উচ্চতার কোনো গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিন। মাছিগুলো রসের লোভে উড়ে এসে ছিদ্র দিয়ে বোতলের ভেতরে ঢুকে যায় এবং সাধারণত বোতল থেকে রেব হয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না এবং রসে ডুবে যায়।
তাত্ত্বিকভাবে এটি উপযুক্ত। তবে, আমি ক্ষেতে গিয়ে দেখেছি, কৃষকেরা ফাঁদগুলো ক্ষেতে ব্যবহার করছে ঠিকই কিন্তু তারা সেগুলো ফেলে রাখে। ফলে কমলার রস পচে কালো হয়ে যায়। কৃষকেরা দু-একবার এই কৌশল ব্যবহার করে আর করে না। আসলে এর পরেও ফাঁদগুলির আরও কিছু উন্নতির দরকার ছিল।
মেডফ্লাইয়ের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত লড়াই শুরু হয় তিন বছর আগে, যখন আমরা তাদের পেয়ারা গাছ থেকে তাড়াতে পারছিলাম না। কীটতত্ত্ববিদ লুই ক্রেসপো আমাদের বলেছিলেন, ফলের মাছিরা পেয়ারা এত বেশি পছন্দ করে যে, পিচফল চাষিদের কীটপতঙ্গ দমনের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পেয়ারা গাছ কেটে ফেলতে হবে। তবে, লুই অনুগ্রহ করে আমাদের একটি ফেরোমেন ফাঁদের কৌশল দেন। যেটি প্রয়োগ করলে ফলের মাছিরা যৌনতার লোভে আকৃষ্ট হয়। মাছিগুলো ফাঁদের আঠালো পৃষ্ঠে বসে এবং মারা যায়।
ফেরোমোনস নির্দিষ্ট একটি সাধারণ প্রজাতির মাছিদের ফাঁদে ফেলে, কিন্তু আমাদের পেয়ারা বাগানে নানা প্রজাতির ফলের মাছির দৌরাত্ম্য ছিল। আমাদের পেয়ারা বাগানের চারপাশের মাটি দ্রুত প্রজনন করতে পারে এমন ফলের মাছি ও কীট দিয়ে পূর্ণ ছিল। আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা পেয়ারা গাছ ছেঁটে দিয়েছিলাম, যাতে গাছে ফল না ধরে। তবে, গত বছরও আমরা আমাদের টমেটোতে এমন কি অ্যাভোকাডোতে ফলের মাছির লার্ভা পাই।
যুদ্ধ চলছে। আমরা আমাদের অ্যাভোকাডোতে ফলের মাছিগুলোকে ঘৃণা করতে শুরু করি এবং ওদের তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য এইটাই ছিল আমাদের শেষ সুযোগ। আমরা আমাদের টমেটো গাছগুলো উপড়ে ফেলি। আমার স্ত্রী আনা ও তার বাবা কয়েক ডজন ফাঁদ তৈরি করেন। এমন কি পপ বোতল দিয়ে তৈরি প্রযুক্তি বিকশিত হতে পারে। আমরা কৃষি কলেজের সৌজন্যে আয়োজিত স্থানীয় মেলায় শিক্ষার্থীদের প্রদর্শিত উন্নত মডেলগুলোও দেখি।
মাছি ঢোকার ছিদ্রগুলোর চারপাশে হলুদ রঙের ডোরা এঁকে আপনি আরও ভালো ফাঁদ তৈরি করতে পারেন। হলুদ রং দেখলে ফলের মাছিগুলো আকৃষ্ট হয়। দুটি বোতল নিন এবং টি-আকারের একটি ফাঁদ তৈরি করুন। মাছিগুলো রস থেকে সোজা বোতলের ওপরের দিকে ওঠার সাথে সাথে দ্বিতীয় বোতলে গিয়ে আটকা পড়ে এবং বেরিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় না। হালকা শীতের সময়, প্রতিটি পপ বোতলের ফাঁদে আমরা দুই থেকে চারটি মাছি ধরতে পারি, যেখানে একটি বোতল দিয়ে তৈরি পুরনো ফাঁদগুলোতে বড়োজোর একটি কি দুটি মাছি ধরা যেত।
এটা মনে হতে পারে যে, মাছিদের জন্য টাটকা রস চেপে নেওয়া হলো কমলার অপচয়। তবে, আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি, কমলার রস একমাস পুরনো হলেও ফলের মাছি ঝাঁকবেঁধে উড়ে আসে। কেননা, তারা গঁজে ওঠা ফল ও সবজির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।
আপনি যদি শত শত পপ বোতল জোগাড় করতে পারেন, তো ফাঁদগুলো বাণিজ্যিক বাগানেও কাজে লাগাতে পারেন। লোকেরা ইতোমধ্যেই হলুদ ফাঁদ তৈরি করতে শুরু করেছে এবং বিকল্প টোপও পাওয়া গেছে [যেমন, চিচা একটি স্থানীয় ও কম অ্যালকোহলযুক্ত মদ, যা কমলার রসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কেননা, এটি সহজে পাওয়া যায় এবং তাড়াতাড়ি গঁজে ওঠে।
আমাদের উন্নতি সত্ত্বেও, একবারে বেশ কয়েকটি অস্ত্র নিয়ে ফলের মাছিদের ওপর আক্রমণ করতে হয়। সব ফলের মাছি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আমাদের ফাঁদগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য বেশি ভালো। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে লকডাউন না হলে আমরা আরও মারাত্মক খাদ্যের ফাঁদ তৈরি করতে কম বিষাক্ত কীটনাশক কিনতাম। এখন আমাদের পরবর্তী অ্যাভোকাডো ফসল না আসা পর্যন্ত জানতে পারবো না যে আমরা ফলের মাছিগুলো নির্মূল করতে পেরেছি কি পারিনি। তবে, এটা ঠিক যে আমাদের হাতে মাছির উপযুক্ত ফাঁদ রয়েছে।
বৈজ্ঞানিক নাম
মেডেটেরিনিয়ান ফলের মাছির বৈজ্ঞানিক নাম সেরাটাইটিস ক্যাপিটাটা (Ceratitis capitata) । তবে, বলিভিয়ার অন্যান্য ফলের মাছির জাতের মধ্যে রয়েছে অ্যানেস্ট্রাপা (Anastrepha) এবং বাক্ট্রোসেরা (Bactrocera) ।
সম্পর্কিত ব্লগ
সম্পর্কিত ভিডিও
ফলের মাছি দমনে খাবারের টোপ ব্যবহার
ফলের পোকা দমনে উইভার-পিঁপড়ার ব্যবহার
মাটিতে পড়ে যাওয়া ফল সংগ্রহের মাধ্যমে ফলের মাছি নিয়ন্ত্রণ
ফল বিনষ্টকারি মাছি দমনে সমন্বিত উদ্যোগ
আরও পড়তে পারেন
Enkerlin, W. R., J. M. Gutiérrez Ruelas, R. Pantaleon, C. Soto Litera, A. Villaseñor Cortés, J. L. Zavala López, D. Orozco Dávila et al. 2017 The Moscamed Regional Programme: Review of a Success Story of Area‐Wide Sterile Insect Technique Application. Entomologia Experimentalis et Applicata 164(3):188-203.