বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য কৃষিশিল্পের সাথে জড়িতরা ও সরকার দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক বা খনিজ সারকে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। সবুজ বিপ্লব শুরু হওয়ার ষাট বছর পরে কৃষিজমি, ভূমির উপরের স্তরের পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানি ও জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা এবং কৃষকদের জীবন-জীবিকা ভারত ও ইউরোপীয় নীতি নির্ধারকদের সারের অত্যধিক ব্যবহার রোধ করতে এবং কৃষিকাজের পরিবেশবান্ধব উপায়গুলোকে উৎসাহিত করতে বাধ্য করছে।
তবে, সারের ব্যবহার নানাভাবে অভিবাসন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক পীড়ন বা আর্থিক অসচ্ছলতা অভিবাসনের সূত্রপাত ঘটায়, জলবায়ুর পরিবর্তন প্রায়ই এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বিশ^জুড়ে প্রাণীর খাবার ও রাসায়নিক সারের মতো কৃষি উপকরণের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে গ্রামীণ অধিবাসীরাও বাড়তি চাপের মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি ইউরোপের কিছুসংখ্যক কৃষক অন্য দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ভারত ও ইউরোপের কৃষকদের উচ্চাহারে আত্মহত্যার ঘটনাও খুবই মর্মান্তিক।
এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও আফ্রিকাতে সারের প্রচার অব্যাহত আছে। অতিরিক্ত বিষাক্ত হওয়ার কারণে বাতিল হয়ে যাওয়া কীটনাশক ইউরোপে নিষিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সার বিক্রি থেকে নিজেদের লাভ বাড়ানোর জন্য আফ্রিকার দিকে ঝুঁকছে।
সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো, দীর্ঘমেয়াদে কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে পারে এমন মাটি তৈরি করা এবং কৃষকদের লাভের পরিবর্তে গবেষকেরা অনেক কাল ধরেই ফলন বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগী। সম্প্রতি ইউরোপীয় কমিশন আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে সুইজারল্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন অর্গানিক এগ্রিকালচার (FiBL)-এর গবেষকেরা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর বিভিন্ন ফসল চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ১২ বছরের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রচলিত খামারের তুলনায় জৈব-খামারে মাটির জৈব-কার্বনের পরিমাণ গড়ে ২০-৫০% বেশি ছিল। যখন জৈব-চাষ পদ্ধতিগুলোর ফলন প্রচলিত পদ্ধতির ফলনের সাথে মিলে যায় বা বেশি হয় তখন নাইট্রোজেন ফিক্সিং, জৈবসার এবং কৃষির ভালো অনুশীলনগুলোর যথাযথ ব্যবহারই ছিল উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি।
সরকার বা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে সারের প্রচার করার কারণে স্থানীয় এলিট শ্রেণি ও অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন কৃষকদের বেশিরভাগের উপকার হয়েছে, ফলে সমাজিক বৈষম্য বেড়েছে। রাসায়নিক সারের প্রতিক্রিয়ার দরুন আধুনিক দানাদার বা সিরিয়াল জাতগুলোর উদ্ভব হয়েছে। ১৯৬০ সালের দিকে সবুজ বিপ্লবের শুরুতে ধান, ভুট্টা ও গম চাষিরা (আধুনিক উচ্চফলনশীল ফসলের জাত, সার ও কীটনাশক)-এর সম্পূর্ণ প্যাকেজ বেছে নিয়ে প্রাথমিকভাবে তাদের ফলন বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে উৎপাদন বাড়ায় বাজরে ফসলের দাম কমে যাওয়ায় তারা মহাজন বা ব্যাংকগুলোর কাছে ক্রমশ ঋণী হয়ে পড়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষকেরা এখন মূল ও কন্দের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। যদি রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হতো তবে, দরিদ্র লোকের শস্য কাসাভার ফলন হেক্টর প্রতি ৫০ টন পর্যন্ত হতো। যা বর্তমানের গড় উৎপাদিত ফসলের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি। আবার, বড়ো কৃষকেরা বাজার ধরার জন্য এর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ক্ষুদ্র চাষিরা লোকসান গুণে এবং তাদের শিশুদের সাথে নিয়ে তারা অন্য জীবিকার সন্ধানে নামে।
আফ্রিকার শহরগুলো ফেটে পড়ছে এবং সেখানে অল্প কিছু অর্থনৈতিক সুযোগ রয়েছে। তাই লোকেরা সবুজ দিগন্ত খুঁজবে এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। আঞ্চলিক অভিবাসন টিকে থাকার একটি সাধারণ কৌশল। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন [আইওএম ২০২০ প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ৩১৮]-এর সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ভূমির অবক্ষয়, ভূমি দখলের নিরাপত্তাহীনতা এবং অনাবৃষ্টি প্রভৃতি পরিবেশগত কারণে পশ্চিম ও উত্তর আফ্রিকার অধিবাসীরা অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছেন। ইউরোপীয় অভিবাসনের ক্ষেত্রে প্রধানত ‘অর্থনৈতিক’ বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছিল যেমন প্রায়ই অভিবাসনের ক্ষেত্রে জলবায়ু ও পরিবেশের মতো প্রধান কারণগুলো উপেক্ষা করা হয়ে থাকে।
তবে, কেবল রাসায়নিক বা খনিজ সার ব্যবহার করলেই পরিবেশগত ক্ষতি হয় না। যেখানে সার উৎপাদন করা হয়, সেখানেও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে, এটি প্রায়শই গোপন রাখা হয়।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ নাউরু ১৯৬৮ সালে যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে স্বাধীনতা লাভ করেছিল তখন এটি বসবাসের জন্য খুব ভালো জায়গা ছিল। যাহোক, সার তৈরির জন্য লবণ মেশানো শিলামাটি খনন করার ফলে মাত্র তিন দশকের মধ্যে দ্বীপটি তার মাটি নষ্ট করে ফেলেছিল। দ্বীপটিতে এখন ফসল ফলানোর কোনো জায়গা নেই। হাস্যকর হলেও সত্য, নাউরুর পুরো জনসংখ্যা অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা ফাস্টফুডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। নাউরুয়ানরা শতকরা ৭০ ভাগই স্থূল, দেশটি এখন উঠান বাগান স্থাপন করতে সংগ্রাম করছে এবং তরুণ জনগোষ্ঠীকে শাকসবজি খেতে উৎসাহিত করছে।
সারের জন্য খনন এবং বাজে প্রশাসন পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটো ও একসময়ের ধনী প্রজাতন্ত্রকে পরিবেশের দিক থেকে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বিধ্বস্ত জাতিতে পরিণত করেছিল : আশ্রয়প্রার্থীদের বহিরাগত হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আশ্রয় নেওয়া অথবা টাকার বিনিময়ে ইন্দোনেশিয়ায় অভিবাসন লাভ করা ছাড়া নাউরুদের হাতে আর তেমন কোনো বিকল্প ছিল না।
যদিও কিছু লোক ও দাতারা এখনও মনে করেন যে, কৃষির একটি শিল্প মডেল সবুজ বিপ্লব আফ্রিকার এগিয়ে যাওয়ার উপায়। তবে, কারো-না-কারো বিরতি দেওয়া উচিত এবং রাসায়নিক [খনিজ] সার ব্যবহারের পরিণতিগুলো দেখে নেওয়া উচিত। যদি আমরা লোকেদের অবস্থান তাদের জমিতে ধরে রাখতে চাই তবে, আমাদের স্বাস্থ্যকর খাদ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যা মাটি যত্নে লালন করে এবং এটিকে স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনশীল রাখে।
আরও পড়ার জন্য
Bhullar, G.S., Bautze, D., Adamtey, N., Armengot, L., Cicek, H., Goldmann, E., Riar, A., Rüegg, J., Schneider, M. and Huber, B. (2021) What is the contribution of organic agriculture to sustainable development? A synthesis of twelve years (2007-2019) of the “long-term farming systems comparisons in the tropics (SysCom)”. Frick, Switzerland: Research Institute of Organic Agriculture (FiBL).
LoFaso, Julia (2014) Destroyed by Fertilizer, A Tiny Island Tries to Replant. Modern Farmer. https://modernfarmer.com/2014/03/tiny-island-destroyed-fertilizer-tries-...
International Organization for Migration (2020). Migration in West and North Africa and across the Mediterranean. International Organization for Migration, Geneva.
সম্পর্কিত অ্যাকসেস এগ্রিকালচার ভিডিওসমূহ
তরল এবং দানাদার অর্গানিক বায়োসার
মাটি ও গাছপালার জন্য ভালো জীবাণু
সার হিসেবে মানুষের মূত্রের ব্যবহার
সম্পর্কিত এগ্রো-ইনসাইট ব্লগসমূহ
Stuck in the middle