
ক্ষয়ে যাওয়া মাটি পুনরায় উন্নত করা যায়, এবং মাটির পুষ্টি ফিরিয়ে আনা যায় যতক্ষণ না কম খরচে মাটি প্রচুর ফসল উৎপাদন করে ততক্ষণ পর্যন্ত। বায়ুম-ল থেকে কার্বন অপসারণ এবং এটিকে পুনরায় মাটিতে ফিরিয়ে আনা। এটিই ডেভিট মন্টগোমেরির ‘গ্রোয়িং আ রেভল্যুয়েশন’ বইয়ের আশাবাদী বার্তা।
পৃথিবীর বহু জায়গায় ঘন-ঘন চাষের ফলে মাটি ক্ষয়ে যায়। বাতাস ও জলের মাধ্যমে মাটির যে ক্ষয় হয় তা আগাছা পরিষ্কার এবং পুষ্টি ভেঙে যাওয়ার মাধ্যমে নিরসন হতে পারে।
প্রচলিত চাষের ফলে গত একশতকের বেশি সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে মূল প্রেইরি মাটির অর্ধেক এবং বেশিরভাগ জৈবপদার্থ নষ্ট হয়ে গেছে। রাসায়নিক সারগুলো অল্প সময়ের মধ্যে মাটিতে ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং নাইট্রোজেনের প্রধান পুষ্টি সরবরাহ করে, তবে, তারা মাইকোরাইজাল ছত্রাক নষ্ট করে মাটির দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য দুর্বল করে ফেলে।
এই মাইকোরাইজাল ছত্রাকগুলো গ্লোমালিন তৈরি করার সময় গাছপালাকে খাবার দেয়, একটি প্রোটিন যা মাটির কণাগুলোকে একত্রে বেঁধে রাখে। কর্ষণ (লাঙল চালানো) ছত্রাক এবং তাদের গ্লোমালিন দিয়ে তৈরি মাটির গঠন ধ্বংস করে ফেলে।
মন্টগোমেরি একজন পেশাদার ভূতাত্ত্বিক। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বেশিরভাগ মাটিরই রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। তাদের পর্যাপ্ত ফসফরাস, পটাসিয়াম ও লৌহ এবং দস্তার মতো সকল ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদান রয়েছে, যা গাছপালার জন্য দরকারি। তবে, এই খনিজগুলো পাথরের কণা ও অন্যান্য নানা আকারে আটকে থাকে, যেগুলো থেকে গাছপালা পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না।
গাছপালার এই পুষ্টি পাওয়ার মূল চাবিকাঠি হলো উপকারী জীবাণু। যেমন, মাইকোরাইজাল ছত্রাক, এই ছাত্রাকগুলো পাথরের টুকরো থেকে খনিজ-পুষ্টি আহরণ করতে পারে এবং জৈবপদার্থকে ভেঙে ফেলতে সাহায্য করে, যাতে গাছপালা এর থেকে পুষ্টি নিতে পারে। জীবাণু গাছপালার সাথে ফসফরাস লেনদেন করে। শিকারী আর্থ্রোপড নেমাটোডা আর প্রোটোজোয়া জীবাণুগুলো খেয়ে নেয় তারপর পুষ্টি উপাদানগুলো মাটিতে ছেড়ে দেয়। একটি বৈচিত্র্যময় মাটির জীবন মাটিকে আরও উর্বর করে তোলে।
কৃত্রিম সার এই লেনদেনে বাধা সৃষ্টি করে এবং এই কারণে মাইকোরাইজাল ছত্রাকগুলো মরে যায়, ফলে শস্য রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। জৈবপদার্থসমৃদ্ধ (অর্থাৎ কার্বন) মাটি স্বাস্থ্যকর এবং উপকারী অণুজীবের একটি বর্ধনশীল গোষ্ঠীকে সহায়তা করে।
কিন্তু ঠিকঠাক পরিচর্যার মাধ্যমে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মাটির সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনা যায়। ঠিক কৌশলগুলো মাটির কার্বন ১% (সাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত মাটি) থেকে ৪% (শান্ত বনের মতো) এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে ৬% পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারে। এধরনের অনেক কৌশল রয়েছে এবং সেগুলোকে ‘সংরক্ষণ কৃষি’, অথবা ‘এগ্রোইকোলজি’, ‘পুনর্জন্মমূলক কৃষি’-সহ নানা নামে ডাকা যায়, এবং এগুলো সাধারণ নীতির ওপর ভিত্তি করে করতে হয়, যেমন, ১. সবসময় মাটি ঢেকে রাখার জন্য কাভার শস্যের আবাদ (বা মাল্চ ব্যবহার করা) ; ২. ঘুরেফিরে ঘাস, শিমজাতীয় মিশ্র শস্যের আবাদ, ৩. নো-টিল, অকর্ষিত (চাষ না-দেওয়া) জমিতে সরাসরি বীজ বপণ করা।
মন্টগোমেরি কনসাস থেকে পেন্সিলভেনিয়া, ঘানা থেকে কোস্টা রিকা পর্যন্ত তাঁর পাঠকদের নিয়ে যান সেইসব কৃষকদের সাথে সাক্ষাৎ করতে, যারা এই তিন নীতির অনুশীলন করেন এবং মুনাফা করেন। কেউ আছেন জৈবচাষি ; অন্যেরা অল্প পরিমাণে নাইট্রোজেন সার বীজের কাছে সরাসরি মাটিতে প্রয়োগ করেন, যেখান থেকে গাছেরা দক্ষতার সাথে তা গ্রহণ করতে পারে। আমরা শিখি যে, কেউ কেউ কেঁচো ব্যবহার করেন, অন্যেরা কোস্টা রিকার ফেলিসিয়া ইচেভেরিয়ার মতো মৃত মাটির জীবন ফিরিয়ে আনতে উপকারী অণুজীবের নিজস্ব গাজন তৈরি করেন। নর্থ ডাকোটার গ্যাবে ব্রাউন বড়ো মাঠে ঘাসে ঢাকা ছোটো জায়গায় গবাদিপশু ঘুরতে দিন। যেন গোরুগুলো ঘাস খাওয়ার সাথে সাথে গোবর-সার দিয়ে মাটি উর্বর করে।
মন্টগোমেরি এবং মৃত্তিকাবিজ্ঞানী রতন লাল অনুমান করেন যে, সংরক্ষণ কৃষি বর্তমান কার্বন নির্গমনের এক তৃতীয়াংশ থেকে দুই তৃতীয়াংশ মাটিতে জৈব উপাদান ফিরিয়ে দিয়ে কম কর্ষণ করার পাশাপাশি জ¦ালানি খরচ কমাতে পারে। সংরক্ষণ-কৃষি গ্রহণে বাধার মধ্যে রয়েছে ভতুর্কি এবং শস্যবীমা, যা কৃষকদের লাঙল চাষ করা এবং রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। আরেকটি হলো আনুষ্ঠানিক গবেষণা, যা কোম্পানি বিক্রি করতে পারে এমন পণ্যের জন্য জারি আছে : জৈবিক সমস্যার রাসায়নিক সমাধান। মন্টগোমেরির মতে, এটি ফেলে রাখা।
মার্কিন কৃষিগবেষণার মাত্র ২ শতাংশ পুনর্জন্মমূলক কৃষির জন্য হয়, সারাবিশে^ যা মাত্র ১ শতাংশ। মাটি পুনরুজ্জীবিত করার বেশিরভাগ উদ্ভাবনী গবেষণার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করা হয় না, বরং কৃষকেরা নিজেরাই তা পরিচালনা করে থাকেন, যারা দেখিয়েছেন যে, সংরক্ষণ-কৃষি, এগ্রোইকোলজি এবং পারমাকালচার কীটপতঙ্গের সামান্য সমস্যা-সহ আরও বেশি উৎপাদনশীল হতে পারে।
সংরক্ষণ-কৃষি ইনপুটগুলোর খরচ কমায়, তাই প্রচলিত কর্ষণের চাষাবাদের চেয়ে এটি বেশি লাভজনক। ঠিকভাবে সংরক্ষিত মাটি সামান্যই ক্ষয় হয় ; বৃষ্টির সময় মাটি পানি শুসে নেয় এবং খরার বছরের জন্য আদ্রতা ধরে রাখে।
মন্টগোমেরি এই কারণে উদ্বিগ্ন যে, যখন বড়ো আকারের খামারিরা কর্ষিত চাষাবাদ থেকে সংরক্ষণ কৃষিতে রূপান্তরিত হয় তখন ভালো ফসল ফলানোর জন্য মাটি যথেষ্ট উন্নত হওয়ার আগে অবশ্যই একটি ক্রান্তিকাল পার করতে হয় যখন বস্তুতই মুনাফা কমে যায়। তিনি শঙ্কিত যে, এতে কৃষকেরা সংরক্ষণ-কৃষিতে রূপান্তরিত হতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। তবু আমি নিশ্চিত যে, কৃষকেরা নিজেরাই এই কাজটি করবেন।
এই প্রাকৃতিক পরীক্ষক হিসেবে কৃষকেরা কম কর্ষণের সাথে ইকোলজিকাল চাষাবাদের অনুশীলন করতে পারেন। প্রথমে একটি জমিতে বা জমির একটি অংশে, তারপরে ধীরে ধীরে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী চর্চা করতে করতে পরে একবারে একটি গোটা প্লটে করতে পারেন। ভালো খবর হলো এই যে, সংরক্ষণ-কৃষি বড়ো খামার বা ছোটো খামার, প্রচলিত বা জৈব, যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক হতে পারে। চাষাবাদ মাটির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারে, এবং এটি ধ্বংস করার প্রয়োজন নেই।
আরও পড়ার জন্য
Montgomery, David R. 2017 Growing a Revolution: Bringing Our Soils Back to Life. New York: Norton. 316 pp.
এক্সেস এগ্রিকালচার সম্পর্কিত ভিডিও
তরল এবং দানাদার অর্গানিক বায়োসার
মাটি ও গাছপালার জন্য ভালো জীবাণু
ভারমিওয়াশ : শস্যের এক জৈব টনিক