ভার্মিওয়াশ বিষয়ের একটি কৃষক-প্রশিক্ষণ ভিডিওচিত্র নির্মাণের জন্য চিত্রনাট্য বা পাণ্ডুলিপি লেখার সময় এটি নিজেই চেষ্টা করার জন্য আমি উৎসাহী ছিলাম, কেননা, আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, গ্রীষ্মপ্রধান ভারতের ধারণাগুলো নাতিশীতোষ্ণ বেলজিয়ামে কাজ করবে কি না।
ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, ভার্মিওয়াশ হলো একধরনের তরল, যা কেঁচোর তৈরি কম্পোস্টের মধ্যদিয়ে পানি গড়িয়ে যাওয়ার পর সংগ্রহ করতে হয়। এটি গাছপালার হরমোন, আয়রন ও জিঙ্কের মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস এবং নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের মতো প্রধান পুষ্টিসমূহ বৃদ্ধির জন্য উপকারি। ভার্মিওয়াশ মাটিতে উপকারী অণুজীবের সংখ্যা বাড়ায় এবং গাছপালাগুলোকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।
অতিমাত্রায় কৃষি-রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে মাটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে যে সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয় তা দেখানোর পরপরই ভিডিওতে দক্ষিণ ভারতের তামিল নাড়ুর স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রেরণামূলক সাক্ষাৎকার দেখানো হয়।
কৃষক শিবমূর্তি বলেন, ‘আপনি যখন মাটির সাথে ভার্মি-কম্পোস্ট মেশাতে চাইবেন তখন আপনার সেগুলো প্রচুর পরিমাণে দরকার হবে। তবে, ভার্মিওয়াশ সরাসরি গাছের পাতায় প্রয়োগ করা যায় ; তাই কম প্রয়োজন হবে এবং আপনি গাছের দ্রুত বৃদ্ধি দেখতে পাবেন। এটি কম্পোস্টের চেয়ে সস্তা।’
আমি আমাদের আরো একটি ভারতীয় অংশীদার ওয়াটারশেড অরগানাইজেশন ট্রাস্ট (WOTR)-কে তরল ভার্মিওয়াশের পাশাপাশি শক্ত এবং সাধারণ কম্পোস্টের চেয়ে শক্তিশালী কম্পোস্ট নির্মাণ বিষয়ে একটি ভিডিও তৈরিতে সহায়তা করেছিলাম। তবে, আমি ভার্মিওয়াশ তৈরির ধারণার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কেননা, এটি তৈরিতে খুব অল্প জায়গার প্রয়াজন হয় এবং এটি আমি আমার শাকসবজি, বেরি এবং অন্যান্য ফল গাছের পাতায় স্প্রে করে ব্যবহার করতে পারি।
স্থানীয় হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে আমি নিচের অংশে ট্যাপ লাগানো একটি ব্যারেল কিনেছি। ভিডিও তৈরির চিত্রনাট্যে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ছোটো ছোটো পাথর দিয়ে ব্যারেলের নিচের অংশ ভরে ফেলতে হবে। তাহলে ট্যাপটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না। আমি হুবহু তাই করেছি। পরে ভিডিওর চূড়ান্ত সংস্করণ থেকে এটি বাদ দেওয়া হয়।
এই ভিডিওটির নির্মাতা শানমুগা প্রিয়ার কাছে যখন আমি জানতে চেয়েছি, তিনি বলেছেন, “কৃষকদের সাথে কথা বলার পর আমার মনে হয়েছে কেউ-ই এটি করছেন না। কারণ, তিন মাস পর তারা ব্যারেল খালি করবেন, কেঁচোগুলো সরিয়ে ফেলবেন এবং তারপর চাষের জমিতে কম্পোস্ট দেবেন। অবশ্যই তারা চান না যে, কম্পোস্টের সাথে পাথরগুলো মিশে যাক।”
ভারতীয় কৃষকেরা ছাকনি হিসেবে কেবল মশারির জাল বা সুতি কাপড়ের একটি টুকরা ব্যবহার করেন। দারুণ, এটি একটি ভালো শিক্ষা ছিল। সম্প্রসারণকর্মীদের কাছ থেকে যেকোনো কৌশল শেখার পর কৃষকেরা সেটিকে আরও উন্নত করার একটা-না-একটা উপায় খুঁজে পায়। আমি এখনো আমার ব্যারেলের তলদেশ নুড়ি ভরা হয়েছে। ভার্মিওয়াশের নতুন আরেকটি আবর্তন [ব্যাচ] স্থাপন করার সময় নুড়িপাথরগুলো বেছে ফেলতে আমাকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হবে।
ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা সবুজ রঙের নয়, এমন কিছু শুকনো পাতা নিচের অংশে রেখে দিতে হবে। তাহলে সব একসাথে না পচে ধীরে ধীরে পচবে। আমার কাছে প্রচুর পরিমাণে শুকনো ওক পাতা আছে। যদিও তারা ধীরে ধীরে পচে যায় তবুও আমি ভাবছিলাম, এতে কাজ হবে কি না। কিন্তু, আমার কাছে যা আছে আমি তাই দিয়ে চেষ্টা করব।
এরপর ভিডিওটিতে দেখা যায়, কীভাবে সমপরিমাণ ধানগাছের খড় যুক্ত করতে হয়। ধানগাছের পরিবর্তে আমি গমগাছের খড় ব্যবহার করেছি, কেননা, আমার চিলেকোঠায় এখনো অনেক গমগাছের খড়ের বান্ডিল রয়েছে।
এর পরের অংশটিও ছিল কিছুটা কৌশলপূর্ণ। ভিডিও-তে ৫ থেকে ১০ কেজি পচা গোবর দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম যে, আমার ভেড়ার গোবরেও একই কাজ হবে। আমি আমাদের ভারতের অংশীদারদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেছি। তারা বারবারই বলেছেন যে, একমাত্র গোবরই উপকারী অণুজীবের একটি কার্যকর উৎস। আমি আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করি, যিনি একজন মাটিবিজ্ঞানী, কিন্তু এখনো এর কোনো সদোত্তর আমি পাইনি। মাটিবিজ্ঞানীরা মাটির ভেতরের গাঠনিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে যতটা জানেন এর জটিল জীববিজ্ঞান সম্পর্কে ততটা হয়ত তাদের জানা থাকে না।
ব্যারেলের ভেতরে কিছু পানি দেওয়ার পরে আমি আমার কম্পোস্ট থেকে কয়েক মুঠ কেঁচো সংগ্রহ করি এবং সেগুলো ব্যারেলে ছেড়ে দিই। আমি খুব তাড়াতাড়ি দেখতে পাবো আমার আয়োজনে কাজ হয় কি না। যদিও ভারতের কৃষকেরা মাত্র ১০দিন পরে ভার্মিওয়াশ সংগ্রহ করতে পারে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, বেলজিয়ামে বসন্তের প্রথম দিনগুলো এখনো বেশ শীতল, তাই কীটগুলো এখনো তেমন সক্রিয় নয়। ছয় সপ্তাহ পরে, যদিও আমরা আনন্দের সাথে আমাদের প্রথম লিটার ভার্মিওয়াশ সংগ্রহ করেছি।
১০ লিটার পানি মিশিয়ে পাতলা করার পর অন্যান্য গাছে প্রয়োগ করার পূর্বে আমি পরীক্ষামূলকভাবে আমার ‘রুবার্ব’ গাছের পাতায় ভার্মিওয়াশ স্প্রে করি। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পাতাগুলো চকচকে ও গাঢ় সবুজ রঙের হয়ে ওঠে। গাছগুলো দেখতে স্বাস্থ্যবান দেখায়, দেখে আমার প্রতিবেশীরা মন্তব্য করেন, এমনকি তারা আমার কাছে জানতে চান যে, আমি গাছগুলোতে কী দিয়েছি।
আমার স্ত্রী মার্সেলা ছোট্ট একটি কাচের ঘরে শাকসবজির চারা লালন-পালন করছিলেন, যখন সেগুলো বাইরে বের করে বাগানে রোপণের সময় হলো তখন তিনি একটি পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেনÑ একগুচ্ছ সরিষা গাছের চারা সোজা মাটিতে রোপণ করা হবে, এবং অন্য একগুচ্ছ চারার গোড়া তিনি ১৫ মিনিট খাঁটি ভার্মিওয়াশে ভিজিয়ে রেখে তারপর রোপণ করবেন। সর্বোপরি এই ভিডিওতে দেখানো হয় যে, এটি যদি ধানের চারা রোপণের বেলায় করা যায়, তাহলে শাকসবজির বেলায় নয় কেন ?
আবার, এর প্রভাব ছিল লক্ষ্য করার মতো। যেগুলোর গোড়া ভার্মিওয়াশে ভেজানো হয়েছিল সেগুলোতে খুব দ্রুত শেকড় গজালো, অন্য দলের চারাগুলোতে কেবল একটি অংশেই শেকড় গজালো।
কোভিড-১৯ সংকটের কারণে বহু লোক বাড়ি থেকে বের হয়ে ভ্রমণে যেতে পারছেন না। এই জন্য অনেক কৃষক, ছাত্র এবং সমাজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে লোকেরা এই সময়গুলো সৃষ্টিশীল কাজ ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য অনেকের মতো আমরাও বাগানে অনেক বেশি সময় দিতে সক্ষম হয়েছি, এবং আমরা দক্ষিণ গোলার্ধের কৃষকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করেছি।
আমরা ভারতীয় কৃষকদের ব্যবহৃত উপাদানের পরিবর্তে ওক গাছের শুকনো পাতা, গম গাছের খড় এবং ভেড়ার গোবর ব্যবহার করে দেখতে পেলাম যে, তামিল নাড়ুতে যেমন কাজ করে তেমনি ফ্ল্যান্ডারসেও [বেলজিয়ামসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ] একইরকমভাবে কাজ করছে। আসলে ভালো প্রশিক্ষণ ভিডিওগুলো লোকেদের নতুন ধারণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে উৎসাহিত করে এবং সেগুলোকে নিজেদের অবস্থার সাথে খাপখাইয়ে নিতে অনুপ্রাণিত করে। এটি হ'ল "অ্যাক্সেস এগ্রিকালচার" (www.accessagriculture.org/bgl) এর দর্শন এবং পদ্ধতির: ভিডিওকে বিশ্বব্যাপী অনুপ্রেরণার উত্স হিসাবে ব্যবহার করা।
অ্যাক্সেস এগ্রিকালচার সম্পর্কিত ভিডিও